পাপকর্ম মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
ছোট বা বড় যেকোনো গুনাহই অন্তরকে অন্ধকার করে তোলে এবং আমলকে নষ্ট
করে দেয়। কুরআন ও হাদিসে বারবার সতর্ক করা হয়েছে পাপ কাজ থেকে
বেঁচে থাকার জন্য। গীবত, মিথ্যা, সুদ, অশ্লীলতা, অন্যায়ভাবে কারো
অধিকার নষ্ট করা—এসবের প্রতিটি আল্লাহর কাছে বড় গুনাহ। তাই একজন
মুমিনের কর্তব্য হলো সর্বদা আল্লাহকে ভয় করা, হারাম ও সন্দেহজনক
কাজ থেকে দূরে থাকা এবং কোনো ভুল হলে সাথে সাথে তওবা করে আল্লাহর
কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
যেকোনো ছোট-বড় গুনাহের জন্য পড়া যায়। ফরজ ও নফল নামাজের পর পড়লে মন ও হৃদয় শুদ্ধ হয়। যে ব্যক্তি এই দোয়া পড়ে, তার মন আল্লাহর স্মরণে নিয়োজিত থাকে এবং তাওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি হয়।
অর্থ : আমি ওই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, যিনি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোনো মাবুদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং তার কাছেই (তাওবাহ করে) ফিরে আসি।
1. সগিরা গুনাহ (ছোট গুনাহ) মাফ হওয়ার ব্যাপারে কুরআন ও
হাদীসে পরিষ্কারভাবে কিছু নির্দেশনা এসেছে। সংক্ষেপে বললে
– ফরয নামাজ আদায় করা। রাসূল ﷺ বলেছেন: "পাঁচ ওয়াক্ত
নামাজ, এক জুমা থেকে আরেক জুমা, এক রমযান থেকে আরেক রমযান
— এর মাঝে যা কিছু (ছোট) গুনাহ হয়, তা মাফ করে দেয়, যদি বড়
গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়।" (সহিহ মুসলিম)
2. অজু করা: রাসূল ﷺ বলেছেন: "যখন বান্দা অজু করে, তখন
অজুর পানির সাথে সাথে তার গুনাহ বের হয়ে যায়, এমনকি তার
নখের নিচ থেকেও।" (সহিহ মুসলিম)
ভালো আমল করা: আল্লাহ বলেন: "নিশ্চয়ই সৎকর্মসমূহ
অসৎকর্মসমূহকে মিটিয়ে দেয়।" (সুরা হূদ: 114)
3. নিয়মিত জিকির ও দোয়া করা: “সুবহানাল্লাহ,
আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার” ইত্যাদি জিকির করলে সগিরা
গুনাহ মাফ হয়।
রাসূল ﷺ বলেছেন: "যে ব্যক্তি ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া
বিহামদিহি’ একশ বার পড়বে, তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া
হবে, যদিও তা সাগরের ফেনার মত হয়।" (সহিহ বুখারি ও
মুসলিম)
4. মাসের রোযা: রাসূল ﷺ বলেছেন: "যে ব্যক্তি ঈমান ও
সওয়াবের আশায় রমযান মাসের রোযা রাখবে, তার পূর্বের
গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।" (সহিহ বুখারি ও
মুসলিম)
হজ্জ ও উমরাহ: হজ্জ করলে আগের গুনাহ মাফ হয়ে যায়, যদি
আল্লাহ কবুল করেন। উমরাহ থেকে উমরাহ পর্যন্ত যা কিছু (ছোট
গুনাহ) হয়, তা মাফ হয়ে যায়। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
1. আল্লাহর কাছে আন্তরিক তাওবা করা: তাওবার মূল শর্ত
তিনটি: গুনাহ ছেড়ে দেওয়া – যে কবিরা গুনাহ করছে, সেটা সাথে
সাথে ছেড়ে দিতে হবে। আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হওয়া – অন্তর
থেকে কষ্ট পাওয়া, লজ্জিত হওয়া, আফসোস করা এবং আবার না করার
দৃঢ় সংকল্প করা – ভবিষ্যতে আর কখনো করবো না এই নিয়ত
করা।
➡️ যদি গুনাহ মানুষের হক (অধিকার) সম্পর্কিত হয় (যেমন কারো
টাকা চুরি করা, গীবত করা, কারো সম্পদ দখল করা), তবে একটি
চতুর্থ শর্ত আছে: 👉 মানুষের হক ফেরত দেওয়া বা ক্ষমা
চাওয়া।
2. নেক আমল বাড়ানো: তাওবার সাথে সাথে বেশি বেশি সৎকর্ম
করলে গুনাহ মোচন হয়। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয়ই সৎকর্মসমূহ
অসৎকর্মসমূহকে মিটিয়ে দেয়।” (সূরা হূদ: 114)
3. নামাজ, রোযা, হজ্জ ইত্যাদি ইবাদত: হজ্জ মাবরুর
(গ্রহণযোগ্য হজ্জ) করলে পুরনো সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
রমযানে কিয়ামুল লাইল (তারাবীহ/তাহাজ্জুদ) করলে, ইমান ও
সওয়াবের আশায় রোযা রাখলে, আগের গুনাহ মাফ হয়। (সহিহ বুখারি
ও মুসলিম)
4. আল্লাহর রহমতের প্রতি আশা রাখা: আল্লাহ বলেন: “হে আমার
বান্দাগণ, যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর
রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করে
দেন। নিশ্চয়ই তিনিই পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা
যুমার: 53)
✅ সারসংক্ষেপ সগিরা গুনাহ → ফরয নামাজ, জুমা, রমযান, অজু,
জিকির ইত্যাদির মাধ্যমে মাফ হয়। কবিরা গুনাহ → কেবল তাওবা
করলে মাফ হয়, আর মানুষের হক থাকলে তা ফেরত দিতে হবে।
আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন 🌸
কবরের আজাব থেকে বাঁচার জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজেও আল্লাহর
কাছে দোয়া করতেন এবং আমাদেরকেও নিয়মিত দোয়া করার নির্দেশ
দিয়েছেন।
🔹 কবরের আজাব থেকে মুক্তির জন্য দোয়া
১. নামাজে (তাশাহহুদ শেষে) দোয়া: রাসূল ﷺ শিখিয়েছেন, যখন
কেউ নামাজ শেষ করার আগে দোয়া করবে তখন বলবে:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ،
وَمِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ، وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا
وَالْمَمَاتِ، وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ
الدَّجَّالِ
উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা ইন্নী আ‘উযু বিকা মিন
‘আযাবিল-কবর, ওয়া মিন ‘আযাবি জাহান্নাম, ওয়া মিন
ফিতনাতিল-মাহইয়া ওয়াল-মামাত, ওয়া মিন শাররি
ফিতনাতিল-মাসীহিদ-দজ্জাল।” অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার
কাছে আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে, জাহান্নামের আযাব থেকে,
জীবন ও মৃত্যুর পরীক্ষার অনিষ্ট থেকে এবং মসীহ দজ্জালের
ফিতনার অনিষ্ট থেকে। (সহিহ মুসলিম)
২. দৈনন্দিন ছোট দোয়া
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ
উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা ইন্নী আ‘উযু বিকা মিন ‘আযাবিল-কবর।”
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয়
চাই।
🔹 কবরের আজাব থেকে বাঁচার কিছু আমল
* নিয়মিত নামাজ পড়া – নামাজ কবরের আযাব থেকে রক্ষা করে।
সুরা আল-মুলক (সুরা তাবারাক) প্রতিরাতে পড়া – হাদীসে
এসেছে, এটি কবরের আযাব থেকে রক্ষা করে। (তিরমিজি)
* গুনাহ থেকে দূরে থাকা – বিশেষ করে মিথ্যা বলা, গীবত,
পরনিন্দা, প্রস্রাব থেকে না বাঁচা ইত্যাদি। তাওবা করা – বড়
গুনাহ থেকে ফিরে আসা।
📖 কুরআন: “চোর পুরুষ হোক বা চোর নারী—তাদের হাত কেটে দাও,
যা তারা অর্জন করেছে তার প্রতিফল হিসেবে। এটি আল্লাহর পক্ষ
থেকে নির্ধারিত শাস্তি। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী,
প্রজ্ঞাময়।” (সূরা মায়িদা ৫:৩৮)
📖 হাদীস : রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: "যদি ফাতিমাহ বিনতে
মুহাম্মদও চুরি করত, তবে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম।"
সহীহ মুসলিম (হাদীস: 1688)
আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত: কুরাইশরা এক সম্ভ্রান্ত বংশীয়
নারী চুরি করায় তাকে ক্ষমা করার সুপারিশ করে। তখন নবী ﷺ
রাগান্বিত হয়ে বলেন: “তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি ধ্বংস হয়েছে
এ কারণে যে, তাদের মধ্যে কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি চুরি
করলে তাকে ছেড়ে দিত, আর দুর্বল হলে তার শাস্তি দিত।
আল্লাহর শপথ, যদি ফাতিমাহ বিনতে মুহাম্মদও চুরি করত তবে
আমি তার হাত কেটে দিতাম। ”ইসলামে চুরি করা গুরুতর গুনাহ
এবং সমাজের জন্য বড় অপরাধ।
🔹 ইসলামে চুরির শাস্তি: হাত কেটে দেওয়া – যদি সমস্ত শর্ত
পূর্ণ হয় (যেমন: চুরি প্রমাণিত হতে হবে, গোপনে করতে হবে,
চুরির পরিমাণ নির্দিষ্ট সীমার উপরে হতে হবে, জোরপূর্বক না
হয়ে নিজের ইচ্ছায় করতে হবে, চুরি বৈধ সম্পদ থেকে হতে হবে
ইত্যাদি)। তাওবা করলে ক্ষমা – যদি কেউ চুরি করার পর
সত্যিকারের অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা
করে, তাহলে আল্লাহ চাইলে তার গুনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন।
দুনিয়ার আইন অনুযায়ী শাস্তি – অনেক দেশে ইসলামী শাস্তি
কার্যকর হয় না, তবে জেল, জরিমানা বা অন্য শাস্তি দেওয়া
হয়।
🔹 আখিরাতের শাস্তি: যদি তাওবা না করে মারা যায়, তবে
আখিরাতে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। নবী করীম ﷺ
বলেছেন: “চোর যখন চুরি করে, তখন সে ঈমানের পূর্ণ অবস্থা
নিয়ে চুরি করে না। অর্থাৎ চুরি মানুষের ঈমান দুর্বল করে
দেয়।” (বুখারি ও মুসলিম)
তওবার মূল শর্ত:
🔹 সৎ অনুশোচনা (ইক্লাস)
🔹 গোনাহ ত্যাগ করা এবং ভবিষ্যতে না করা
🔹 যদি কারো অধিকার লঙ্ঘন করে থাকে, তা ফিরিয়ে দেওয়া
🔹 আল্লাহর কাছে দোয়া ও সহমর্মিতা
কোরআনে আল্লাহ বলেন:
وَيَعْفُو عَنِ ٱلْخَطِيٓـَٔةِۭ وَيَغْفِرُ ٱلذَّنْبَۗ وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدْ فَازَ فَوْزًۭا عَظِيمًۭا
ওয়া ইয়াফউ ‘আনিল খাতী’য়াতি ওয়া ইয়াগফিরু যাজ-জনবা, ওয়া মানু যুতিইল্লাল্লাহা ওয়া রসুলাহু ফাক্বাদ ফাজা ফাওযান ‘আজীমা
অর্থাৎ “সে (আল্লাহ) গোনাহকে ক্ষমা করেন এবং দোষ মাফ করে দেন। যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আজ্ঞা মানে, তারা নিশ্চিতভাবে মহাবিশাল সাফল্য লাভ করেছে।” (সূরা আত-তোবা, 9:104)
গোনাহ ত্যাগ করা:
🔹 তওবা তখনই গ্রহণ হবে যখন মানুষ পরবর্তীতে সেই গোনাহ থেকে দূরে থাকবে।
🔹 অর্থাৎ শুধুই লজ্জা বা ভয় থেকে নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ছাড়া।
আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনা:
আল্লাহ বলেন: “যারা নিজেদের ভুল থেকে ফিরে আসে, আমি তাদেরকে ক্ষমা করি।” (সূরা আল-ফুরকান, 25:70)
দ্রুত ফিরে আসা
🔹 গোনাহ করার সাথে সাথেই তওবা করলে বরকত বেশি।
🔹 ধীরেধীরে তওবা করলে তা গ্রহণযোগ্য, কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব ফিরা উত্তম।
হাদিস অনুযায়ী তওবার শর্ত ও পদ্ধতি
🔹 নবী ﷺ বলেছেন: “যে ব্যক্তি গোনাহ করে এবং সত্যিকারভাবে অনুশোচনা করে, আল্লাহ তার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন।”(সহীহ বুখারী, 7533; সহীহ মুসলিম, 2749)
🔹 শুধু অনুশোচনা যথেষ্ট নয়, ভবিষ্যতে সেই গোনাহ না করার অঙ্গীকারও থাকতে হবে।
🔹 যদি কারো ক্ষতি করে থাকে (মানুষের অধিকার লঙ্ঘন করে), তবে প্রথমে মানুষকে তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে, তারপর আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে।
🔹 নবী ﷺ বলেছেন: “যদি তোমরা কারো অধিকার লঙ্ঘন কর, তার অধিকার ফিরিয়ে দাও, তারপর আল্লাহর কাছে তওবা করো।” (সহীহ বুখারী, 241)
🔹 তওবা করার সময় আল্লাহর কাছে সরাসরি দোয়া করতে হবে।
উদাহরণ দোয়া:
اللّهُم اغفر لي ذنبي كله، دقه وجلّه وأوله وآخره، علانيته وسره
(হে আল্লাহ! আমার সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করো — ছোট-বড়, প্রকাশ্য-গোপন, প্রথম-শেষ সব)
রাসূল ﷺ বলেছেন: “যে ব্যক্তি সকালে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এটি পাঠ করবে এবং সন্ধ্যার আগেই মারা যাবে, সে জান্নাতে যাবে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এটি পাঠ করবে এবং সকাল হওয়ার আগেই মারা যাবে, সেও জান্নাতে যাবে।”
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রভু, আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবুদ নেই; আপনিই আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমি আপনারই গোলাম, আর আমি আছি আপনার প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের ওপর আমার সাধ্যমতো; আমি আপনার কাছে পানাহ ও আশ্রয় চাই আমার অনাসৃষ্টির অকল্যাণ এবং অপকার ও ক্ষতি হতে। আমি স্বীকার করছি আমার প্রতি আপনার সব নিয়ামত, আরও স্বীকার করছি আপনার সমীপে আমার সকল অপরাধ; সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন, আর অবশ্যই আপনি ছাড়া ক্ষমা করার আর কেউ নেই।